
| বুধবার, ১৫ জানুয়ারি ২০২৫ | প্রিন্ট | 179 বার পঠিত
অহিদুজ্জামান মিঞা :
এনসিসি ব্যাংকের চেয়ারম্যান নুরুন নেওয়াজের বিরুদ্ধে ব্যাংকের অর্থ আত্মসাৎ এবং ঋণ জালিয়াতির অভিযোগের তদন্ত করে তার বিরুদ্ধে যথাযথো আইনগত ব্যবস্থা নেয়ার অনুরোধ জানিয়ে দুর্নীতি দমন কমিশনে অভিযোগ করছেন ব্যাংকটির শেয়ার হোল্ডার মো. জালাল আহমেদ।
ব্যাংক আইন লংঘন করে ব্যাংকটির চেয়ারম্যান হওয়া এবং এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন তোলা হয়েছে এই অভিযোগ পত্রে। তার অনিয়মের কর্মকান্ডে জড়িত ব্যাংকের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেয়ার দাবী জানানো হয় এতে। ব্যাংকের শেয়ারহোল্ডার জালাল আহমেদ গত ১৭ ডিসেম্বর দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) এই অভিযোগটি করেন।
অভিযোগ পত্রে ব্যাংকের ভাইস চেয়ারম্যান মইনউদ্দিন মোনেমের বিরুদ্ধে ঋণ খেলাপীর অভিযোগ করে তাদের দুর্নীতি ও অনিয়মের সমস্ত ঘটনা প্রকাশিত হবার পরও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ থেকে কোন পদক্ষেপ না নেয়ায় বিষ্ময় প্রকাশ করা হয়েছে।
জানা গেছে, ব্যাংকটির বর্তমান চেয়ারম্যান নুরুন নেওয়াজ,তার ছেলে পরিচালক সাজ্জাদ উন নেওয়াজদের কোম্পানী অর্কিড এলপিজির ঋন অধিগ্রহনের বিষয়টি তাদের পরিচয় গোপন করে ব্যাংকের পরিচালনা বোর্ডে অনুমোদন করিয়ে নেন তারা। ব্যাংকের বৈদেশিক শাখার নতুন গ্রাহক রাজ্জাক এন্টারপ্রাইজের নামে অধিগ্রহনের পুরো বিষয়টি তারা জালিয়াতির মাধ্যমে করার চেস্টা করেন। নিজ ব্যাংক হতে নিজেরাই ঋন গ্রহনের জালিয়াতি সংক্রান্ত সমস্ত কাগজপত্র ও পুরো বিষয়টি বাংলাদেশ ব্যাংককে জানানো হলেও এ ব্যাপারে তাদের বিরুদ্ধে কোন ব্যাবস্থা নেয়া হয়নি। জালিয়াতির কারনে যার পরিচালক পদই থাকার কথা নয়, তিনি আবার ব্যাংকটির চেয়ারম্যান হিসেবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমোদন পান কি ভাবে, এ প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে ব্যাংকটির অন্যান্য পরিচালক ও শেয়ারহোল্ডারদের মধ্যে। ব্যাংকের সমস্ত কেনা-কাটা ও নিয়োগে অবৈধ প্রভাব খাটিয়ে বিপুল পরিমান অর্থ আত্বসাতের অভিযোগ উঠেছে চেয়ারম্যান নুরুন নেওয়াজের বিরুদ্ধে।
জানা গেছে, এনসিসি ব্যাংকের সবগুলো ভবন এবং শাখায় ব্যবহারের জন্য বিনা টেন্ডারে বাজার মূল্যের চেয়ে অনেক বেশী দামে নুরুন নেওয়াজের মালিকানাধীন একটি কোম্পানী থেকে এসি কেনা হয়। এতে ব্যাংকের বিপুল পরিমান অর্থ অপব্যয় হয়।
এনসিসি ব্যাংকের ফরেন এক্সচেঞ্জ শাখার গ্রাহক রাজ্জাক এন্টারপ্রাইজ বর্তমান চেয়ারম্যান নুরুন নেওয়াজের এলপিজি স্থাপনা অধিগ্রহন বাবদ ২৬ কোটি টাকা ঋন প্রদানের আবেদন করেন। এর মাঝে ১৬ কোটি টাকা হলো টার্ম ঋন যেটি এলপিজি মেশিনারী,কারখানার জায়গা এবং কোম্পানীর গাড়ী অধিগ্রহনে ব্যবহৃত হবে যেটি আগামী ৮ বছরে পরিশোধযোগ্য। আর ১০ কোটি টাকা ঋন চলতি মূলধন হিসেবে ব্যবহার করা হবে বলে জানানো হয়। ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে আবেদন করা এই ঋন অনুমোদনের জন্য এনসিসি ব্যাংকের তৎকালীন পরিচালক এবং বর্তমান চেয়ারম্যান মো: নুরুন নেওয়াজ নিজেদের পরিচয় গোপন করে এনসিসি ব্যাংকের ফরেন এক্সচেঞ্জ শাখায় ঋন অধিগ্রহনের আবেদনটি করেন। ঋন অধিগ্রহনের জন্য যে অর্কিট এনার্জি লিমিটেড কোম্পানীর ব্যানারে আবেদন জানিয়েছিলেন সেই কোম্পানীটির মালিক ছিলেন মো: নূরুন নেওয়াজ নিজেই। এ কোম্পানীর অন্যান্য পরিচালকরা হলেন তার ছেলে মো: সাজ্জাদ নেওয়াজ এবং তার স্ত্রী শাহিদা নেওয়াজ। ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে এ ঋন প্রস্তাবনা উপস্থাপন করা হয়। এই কোম্পানী অর্কিড এনার্জি লিমিটেড’র মালিক হলেও তা সম্পূর্ন গোপন রাখা হয়। তথ্য গোপন করে নিজ ব্যাংক হতে অধিগ্রহনের নামে ঋন জালিয়াতির চেষ্টা করা হয়। ব্যাংক কোম্পানী ১৯৯১ সালের ২৭ এর ধারা মতে, ব্যাংকের কোন পরিচালক সরাসরি কিংবা গোপনে নিজ ব্যাংক হতে কোন ধরনের ঋন নিতে পারেন না। মো: নুরুন নেওয়াজ নিজে পরিচালক হয়ে অন্য কোম্পানীর ছদ্মাবরনে জালিয়াতির মাধ্যমে তথ্য গোপন করে ঋন অনুমোদন করিয়ে নেয়ায় ব্যাংক কোম্পানী আইনে শাস্তিযোগ্য অপরাধ করেছেন। এতবড় গুরুতর একটি ঋন জালিয়াতির দায়ে অভিযুক্ত পরিচালক নিজেকে পুনরায় ব্যাংকটির চেয়ারম্যান ঘোষণা করেন এবং এ ঘটনায় তাকে শাস্তি না দিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক তার চেয়ারম্যান পদ অনুমোদন করার মাধ্যমে তাকে আরও পুরস্কৃত করেছে।
সংশ্লিস্টরা জানান, ফ্যাসিস্ট সরকারের ঘনিষ্ঠভাজন হিসেবে পরিচিত বর্তমান চেয়ারম্যান নুরুন নেওয়াজ ফেনী-১ আসনের আওয়ামী লীগ এমপি আলাউদ্দিন আহমেদ চৌধুরীর আত্বীয়। তিনি শেখ হাসিনা সরকারের প্রধানমন্ত্রীর দফতরের প্রভাব খাটিয়ে ব্যাংকিং সেক্টরে ক্ষমতার বলয় তৈরি করে নিয়েছিলেন। তিনি সব সময়ই বলতেন আমি শেখ মুজিবের সৈনিক। আমার কেউ কিছু করতে পারবে না। এসব বলেই সমস্ত অপকর্ম করে আসছিলেন মো নুরুন নেওয়াজ। ফ্যাসিস্ট সরকারের এমন একজন দোসর কি করে ৫ আগস্টের রজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর নতুন করে ব্যাংকটির চেয়ারম্যান হতে পারে। বিগত সময়ে মো নুরুন নেওয়াজের এসব অবৈধ কর্মকান্ডের প্রতিবাদ করায় ব্যাংকের অন্যান্য পরিচালকরা হয়রানীর শিকার হন।
বর্তমান চেয়ারম্যান মো নুরুন নেওয়াজের বিরুদ্ধে বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে ক্ষমতাসীনদের যোগসাজসে এনসিসি ব্যাংকের সমস্ত টেন্ডার জালিয়াতি ও ব্যাংকে জনবল নিয়োগে অনিয়ম ও দুর্নীতির সাথে জড়িত থাকার অভিযোগও কার হয়েছে এই অভিযোগ পত্রে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক হতে বর্তমান চেয়ারম্যান মো নুরুন নেওয়াজের বিরুদ্ধে অনিয়মের অভিযোগের তদন্ত করে এক সপ্তাহের মধ্যে একটি তদন্ত রিপোর্ট পাঠাতে প্রথমে গত ১৭ সেপ্টেম্বর এবং পরে ১৪ অক্টোবর চিঠি দেয়া হয় ব্যাংকটিতে। কিন্তু ব্যাংকটি তার অভিযোগের বিষয়ে কোন তদন্ত রিপোর্ট কেন্দ্রীয় ব্যাংকে পাঠায়নি। উপরন্ত বর্তমান চেয়ারম্যান নুরুন নেওয়াজ বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশের তোয়াক্কা না করে ২৮ অক্টোবর ২০২৪ ইং তারিখে অনুষ্ঠিত ব্যাংকের বোর্ড সভায় নিজেকে চেয়ারম্যান প্রার্থী ঘোষণা করেন ও প্রস্তাবটি অনুমোদন করিয়ে নেন।
জানা যায়, ২৮ অক্টোবর অনুষ্ঠিত বোর্ড সভায় ব্যাংকের কয়েকজন পরিচালক কেন তাদের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তদন্তের বিষয়টি এবং তদন্ত সম্পর্কে তাদেরকে জানানো হয়নি, তা জানতে চান। কিন্তু সে সময় নূরুন নেওয়াজের অন্যতম সহযোগি খায়রুল আলম চাকলাদার অন্যান্য পরিচালকদের বিষয়টি নিয়ে বেশী না ঘাটাতে বলেন। বোর্ড মিটিংয়ে দুর্নীতির তদন্ত রিপোর্টকে পাশ কাটিয়ে নুরুন নেওয়াজ নিজেকে চেয়ারম্যান এবং দেশের অন্যতম প্রধান ঋন খেলাপী আব্দুল মোনেম কোম্পানীর ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাইন উদ্দিন মোনেমকে ভাইস-চেয়ারম্যান হিসেবে ঘোষনা করা হয়। অথচ ব্যাংক কোম্পানী আইন অনুসারে এদের কেহই পরিচালক থাকার যোগ্য নন।
উল্লেখ্য, বাংলাদেশ ব্যাংকের তদন্ত অনুসন্ধানে বর্তমান চেয়ারম্যান নুরুন নেওয়াজ, তার ছেলে সাজ্জাদ উন নেওয়াজ,তাদের সহযোগি খায়রুল আলম চাকলাদার এবং অপর পরিচালক আব্দুস সালামের বিভিন্ন জালিয়াতি,দূর্নীতি,অনিয়ম সম্পর্কে জানতে চাওয়া হয়। ভাইস-চেয়ারম্যান মইনউদ্দিন মোনেমের কোম্পানী ইগলুসহ বিভিন্ন কোম্পানীগুলো ইতিমধ্যে ব্যাংক ঋন খেলাপীতে পরিনত হয়েছে। ঋন প্রদানে ব্যর্থতায় তার অনেকগুলো প্রতিষ্ঠান ব্যাংক সিলগালা করে দিলেও সে এখনো ব্যাংক পরিচালক ও ভাইস চেয়ারম্যান হিসেবে বহাল রয়েছেন। ব্যাংকের চেয়ারম্যান মো নুরুন নেওয়াজের বিরুদ্ধে দুদকে করা অভিযোগ সম্পর্কে তার বক্তব্য জানতে তার ব্যাক্তিগত মোবাইলে হোয়াট্সঅ্যাপ নম্বরে কয়েকবার ফোন দেয়া হলেও তিনি ফোনটি রিসিভ করেন নাই। এরপর এ বিষয়ে বক্তব্য জানতে তার হোয়াট্সঅ্যাপ নম্বরে ম্যাসেস অপশনে একটি ক্ষুদে বার্তা পাঠানো হয়। এতেও তিনি কোন সাড়া দেন নাই।
ব্যাংকের চেয়ারম্যান মো নুরুন নেওয়াজের বিরুদ্ধে অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও তাকে অনুমোদন দেয়ার বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের বক্তব্য জানতে মুখপাত্র হুসনে আরা শিখার মোবাইলে হোয়াট্সঅ্যাপ নম্বরে ফোন ও ম্যাসেস অপশনে একটি ক্ষুদে বার্তা পাঠানো হয়। তবে তিনি এ ব্যাপারে কোন সাড়া দেন নাই।
Posted ১২:৫৭ অপরাহ্ণ | বুধবার, ১৫ জানুয়ারি ২০২৫
Arthobiz | zaman zaman