শুক্রবার ২৩শে মে, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ৯ই জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

শিরোনাম >>
শিরোনাম >>

পদ্মা ইসলামী লাইফে দাবী পরিশোধে বেহাল অবস্থা

২৫ হাজার টাকার বীমা দাবী পেতে ৬ বছর অপেক্ষায় দিনমজুর বেল্লাল

  |   রবিবার, ১৯ জানুয়ারি ২০২৫   |   প্রিন্ট   |   136 বার পঠিত

২৫ হাজার টাকার বীমা দাবী পেতে  ৬ বছর অপেক্ষায় দিনমজুর বেল্লাল

অহিদুজ্জামান মিঞা :
’ভাবনাহীন নিরাপদ জীবনের প্রতিশ্রুতি’ শ্লোগান ধারন করে সারাদেশে বীমা ব্যবসা শুরু করে পদ্মা ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি। অথচ এই কোম্পানিতে বীমা করে এখন বীমা টাকার নিরাপত্তা নিয়ে ভাবনায় লাখ লাখ বীমা গ্রাহক। বীমা কোম্পানিটি বীমা ব্যবসার নামে এক ধরনের প্রতারনার ফাঁদ পেতে সাধারণ জনগনের কষ্টার্জিত টাকা লুটে পুটে খাচ্ছে। একদিকে গ্রাহকের বীমাদাবী পরিশোধ করা হচ্ছে না, অপরদিকে বীমা পলিসি বিক্রি করে জনগনের পকেটের টাকা ছিনিয়ে আনছে। গ্রাহকের এই টাকায় কোম্পানির মালিক ও কর্মকর্তাদের বিলাসী জীবন যপান চলছে। আর বীমা করে মেয়াদ শেষে নিজের টাকা ফেরৎ পেতে গ্রাহককে রাস্তায় ঘুরে বেড়াতে হচ্ছে। সঠিক তদারকি ও দেখভালের অভাবে এই কোম্পানিটি এখন একটি ফটকাবাজির বীমা কোম্পানিতে পরিনত হয়েছে।
বেসরকারি জীবন বীমা কোম্পানি পদ্মা ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্সের বিরুদ্ধে বীমা দাবী পরিশোধ না করার অসংখ্য গ্রাহকের অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। পত্রিকার পাঠকদের ও নিয়ন্ত্রক সংস্থান নজরে আনতে এ প্রতিবেদনে মাত্র দু’জন বীমা গ্রাহকের কষ্টের ও ক্ষোভের বর্ণনা তুলে ধরা হলো। কোম্পানিটির বর্তমান ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা নুর মোহাম্মদ ভূইয়া। এই এমডির অতিত রেকর্ড ভাল নয়। তিনি যে কোম্পানির এমডি হয়েছেন, সেই কোম্পানির বারোটা বাজিয়ে ছেড়েছেন। এমন অথর্ব ও অযোগ্য লোককে বীমা কোম্পানির এমডি নিয়োগ দিয়ে এবং সেই নিয়োগ অনুমোদন করে কোম্পানির পরিচালনা বোর্ড ও নিয়ন্ত্রক সংস্থা উভয়ের দায়িত্ব পালন প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। কোম্পানিটির পরিচালনা বোর্ডের বর্তমান চেয়ারম্যান শরিয়ত উল্লাহ্। তিনিও সঠিক ভাবে দায়িত্ব পালনে সম্পূর্ণরুপে ব্যর্থ হয়েছেন। গ্রাহকের বীমা দাবী পরিশোধের বিষয়টি তার কাছে তেমন গুরুত্ব পাচ্ছে না।
কোম্পানিটি ২০০০ সালের ৩০ এপ্রিল ব্যবসার জন্য লাইসেন্স পেয়েছে। নানা অনিয়মে ও দুনীর্তিতে জড়িয়ে দীর্ঘদিন ধরে কোম্পানিটি দুর্বল অবস্থায় রয়েছে। কোম্পানির মোট ২ লাখ ৪৮ হাজার ১৭৬ গ্রাহকের মৃত্যুদাবী ও মেয়াদোত্তর বীমা দাবী বকেয়া রয়েছে। সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ি ২০২৪ সালের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পযর্ন্ত ৯ মাসে কোম্পানিটির ২৩১ কোটি ৮ লাখ ৯ হাজার টাকার বীমা দাবী উত্থাপিত হয়। এর মধ্যে মাত্র ১ কোটি ৮৭ লাখ ৩৯ হাজার টাকার বীমা দাবী পরিশোধ করা হয়। এ সময়ে অনিষ্পন্ন দাবী রয়েছে ২২৯ কোটি ২০ লাখ ৬৯ হাজার টাকা। তবে বছর শেষ নাগাদ এই টাকার পরিমান আরও বেশি হবে বলে জানা গেছে।
বর্তমানে কোম্পানিটির লাইফ ফান্ড বলে কিছু নেই। কোম্পানির মালিক ও কর্মকর্তারা সব লুটে পুটে খেয়ে এটি শেষ করে দিয়েছে। কোম্পানির লাখ লাখ বীমা গ্রাহক মেয়াদোত্তর বীমা দাবী ও মৃত্যুদাবীর টাকা ফেরত পাচ্ছে না। প্রচলিত বীমা আইনে মেয়াদ পূর্তির তারিখ থেকে ৯০ দিনের মধ্যে গ্রাহকের বীমা দাবীর টাকা পরিশোধ করার আইনগত বাধ্যবাধকতা রয়েছে। অথচ কোম্পানিটি মাসের পর মাস বছরের পর বছর ধরে গ্রাহককে তার দাবীর টাকা ফেরৎ না দিয়ে হয়রানি করে আসছে। ভূক্তভোগি অসংখ্য বীমা গ্রাহক কোম্পানিটির প্রধান কার্যালয়ে ধর্ণা দিয়ে তাদের টাকা পাচ্ছে না। এমনকি ভূক্তভোগি বীমা গ্রাহকেরা বীমা নিয়ন্ত্রক সংস্থা বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রন কর্তৃপক্ষে (আইডিআরএ) অভিযোগ করেও কোন প্রতিকার পাচ্ছেন না বলে অভিযোগ করেছেন। মেয়াদ শেষে গ্রাহকের বীমা দাবী পরিশোধের ফাইল চূড়ান্ত অনুমোদন দেয়ার পরও টাকা না দিয়ে দীর্ঘ সময় ফাইলটি আটকিয়ে রাখা হচ্ছে। সংশ্লিষ্ট শাখা থেকে বলা হচ্ছে, এমডি স্যারের নির্দেশ ছাড়া কাউকে চেক দেয়া যাবে না। এমডি স্যার বললেই চেক দেয়া হবে। এ ভাবে এমডির নির্দেশের অজুহাত দেখিয়ে বীমা গ্রাহকের মেয়াদোত্তর বীমা দাবীর টাকা বছরের পর বছর আটকিয়ে রাখা হচ্ছে। ভূক্তভোগি একাধিক বীমা গ্রাহক অর্থবিজ পত্রিকা অফিসে এসে কোম্পানিটির বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ করেছেন।
সিরাজগঞ্জ জেলার কামারখন্দ এলাকার আবুল হোসেন মন্ডলের ছেলে বেল্লাল হোসেন ভূক্তভোগি বীমা গ্রাহকদের একজন। মো. বেল্লাল হোসেন ২০০৮ সালের ডিসেম্বর মাসে মাসিক ৫ শত টাকা কিস্তিতে দশ বছর মেয়াদি ৬০ হাজার টাকার একটি বীমা করেন ( পলিসি নম্বর- ০৫১২৯০৬২২২৯)। তিনি ৪৫টি কিস্তি দিয়ে অর্থাভাবে আর কোন কিস্তির টাকা জমা দিতে পারেন নাই। ২০১৮ সালের ডিসেম্বর মাসে তার বীমা চুক্তির মেয়াদ শেষ হয়। তার মাত্র ২৫ হাজার টাকার বীমা দাবী। মেয়াদ শেষে কোম্পানির সাথে যোগাযোগ করা হলে তাকে দীর্ঘ সময় ঘুরিয়ে অবশেষে ব্যাংক হিসাব খুলে ব্যাংকের নাম ঠিকানা ও হিসাব নম্বর জমা দিতে বলা হয়। তিনি সবকাজ সম্পন্ন করার পরও অদ্যাবদি দীর্ঘ ৬ বছরেও তার বীমা দাবীর টাকা ফেরৎ পাননি। হিসাব বিভাগ থেকে তাকে বলা হয়েছে, এমডি স্যার বললেই চেক দেয়া হবে। এমডি স্যার বলেন না, ফলে তিনি আর বীমার টাকা পাচ্ছেন না। একজন সাধারন বীমা গ্রাহকের পক্ষে একটি বীমা কোম্পানির এমডি সাহেবের সঙ্গে দেখা করা কতোটা সম্ভব ? বীমা চেক পেতে কেন এমডি স্যারের সাথে কথা বলতে হবে। কোম্পানিটি এ ভাবে বীমা গ্রাহকদের সাথে দীর্ঘদিন প্রতারনা করে আসছে।
কোম্পানির অপর এক হতদরিদ্র বীমা গ্রাহক আয়শা খাতুন। তিনি মেয়াদোত্তর বীমা দাবী মাত্র ৪৭ হাজার ৭৯২ টাকার জন্য ৬টি বছর এই কোম্পানিতে ঘুরছেন। তার অভিযোগ আমরা দিনমজুর। খেটে খাওয়া মানুষ। দিন এনে দিন খাই। কোম্পানির লোকের অনেক অনুরোধে ও তাদের প্রলোভনে পড়ে বীমা করেছি। প্রতি মাসে খুব কষ্ট করে ৫’শত টাকা করে জমা দিয়েছি। মেয়াদ শেষে আমাকে অনেক লাভের টাকা দেয়ার প্রলোভন দেখানো হয়েছিল। কিন্তু এখন লাভ দুরে থাক, আমার আসল টাকার জন্য আজ ৬টি বছর ঘুরছি। টাকা কবে নাগাদ পাওয়া যাবে, এ বিষয়ে কেউ কিছু বলতে পারছে না। তার পক্ষে সিরাজগঞ্জ থেকে মাসে মাসে ঢাকায় এসে এই টাকার জন্য খোজ নেয়াও সম্ভব হচ্ছে না।
হতদরিদ্র বীমা গ্রহীতা আয়শা খাতুন ২০০৮ সালের ২৫ ডিসেম্বর মাসিক ৫ শত টাকা কিস্তিতে ৬০ হাজার টাকার একটি বীমা করেন। তার বীমা পলিসি নম্বর- ০৫১৪৮০০৭১৭১। ২০১৮ সালের ২৫ ডিসেম্বর তার বীমার মেয়াদ পূর্তি হয়। আয়শা খাতুন যথাসময়ে তার বীমার টাকা ফেরৎ চেয়ে আবেদন করেন। কোম্পানির পক্ষ থেকে তাকে চিঠি দিয়ে ব্যাংক হিসাব খুলে ব্যাংকের নাম ঠিকানা ও হিসাব নম্বর কোম্পানির নির্ধারিত ফরমে নিজ হাতে লিখে কোম্পানিতে জমা দিতে বলা হয়। এ সব পূরন করার পরও কোম্পানিটি তার টাকা দিচ্ছে না। তিনি জানান, নিজ এলাকায় ঢাকায় থাকেন, এমন অনেক লোককে ধরেছি, টাকাটা তুলে দিতে, তাদের কেউ কেউ চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছেন। তার জিজ্ঞাসা, এখন কার কাছে গেলে আমার টাকাটা পেতে পারি।
কেন বীমা গ্রাহকের টাকা দেয়া হচ্ছে না, জানতে এ বিষয়ে কথা বলার জন্য কোম্পানির মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা নূর মোহাম্মদ ভূইয়ার মোবাইল নম্বরে ফোন দিলে তিনি নিজে মোবাইলটি না ধরে তার পিএসকে দিয়ে ধরান। পিএস তার পরিচয় দিয়ে বলেন, স্যার বাইরে আছেন, আপনার কিছু জানার থাকলে আমাকে বলতে পারেন। তাকে বলা হয়, না এমডি সাহেবের সঙ্গেই কথা বলতে হবে। আপনার এমডি স্যার আসলে তাকে বলবেন, অর্থবিজ পত্রিকা থেকে ফোন দিয়েছিল। বীমা গ্রাহকের মেয়াদোত্তর টাকা না দেয়ার কারন জানতে চেয়েছে। তিনি ফোন না করলে আমিই আবার ফোন দিব। দীর্ঘ সময়েও তিনি ফোন না দেয়ায় তাকে পুনরায় ফোন দেয়া হলেও তিনি বা তার পিএস আর ফোনটি রিসিভ করেন নাই। পরে কোম্পানির চেয়ারম্যান শরিয়ত উল্লাহকে ফোন করা হলে তিনিও ফোন রিসিভ করেন নাই। অবশেষে এমডিকে তার হোয়াটস্অ্যাপ নম্বরে ক্ষুদে বার্তায় তার কোম্পানির বীমা গ্রাহকের করা অভিযোগ জানানো হয় এবং তার কাছে জানতে চাওয়া হয় ৬ বছরেও কেন তাদের বীমা দাবী পরিশোধ করা হচ্ছে না। কিন্তু কোম্পানির এমডি এ বিষয়ে কোন বক্তব্য দেন নি। ফলে এ বিষয়ে পদ্মা ইসলামী লাইফের কোন বক্তব্য দেয়া সম্ভব হলো না।
জানা গেছে, দুর্বল জীবন বীমা কোম্পানিগুলোর উন্নয়ন কর্মীরা মাঠ পযার্য়ে বীমা পলিসি বিক্রয় করে প্রিমিয়ামের টাকা কোম্পানির হিসাবে জমা দেয়ার আগে তাদের বেতন ভাতা ও কমিশন প্রাপ্তি নিশ্চিত করে নেন। তাদের কমিশন ও বেতন ভাতার টাকার চেক হাতে পেয়ে টাকা জমা দেন। এই টাকা নিয়ে এমডি সাহেব ও তার সহকর্মীরা নিজের বেতন ভাতা ও অফিস ভাড়া মেটান। লাইফ ফান্ড ও বিনিয়োগের খাতা শূন্য থাকে। তাহলে ভবিষ্যতে এই কোম্পানির গ্রাহকরা কি ভাবে তাদের বীমা দাবীর টাকা ফেরৎ পাবেন?। এ সব বিষয় খতিয়ে দেখার দায়িত্ব নিয়ন্ত্রক সংস্থার। বীমা আইনে নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে ক্ষমতা দেয়া হয়েছে, অথচ তারা সেই ক্ষমতার যথাযথ ব্যবহার করেন না। আইন না মেনে বীমা ব্যবসা করলে সংশ্লিষ্ট বীমা কোম্পানির ব্যবসায়িক লাইসেন্স স্থগিত করা অথবা বাতিল করার বিধান রয়েছে আইনে। কিন্তু অনেক অনিয়মের অভিযোগ উত্থাপিত হবার পরও এমন কঠোর কোন পদক্ষেপ নেয়ার দৃষ্টান্ত নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে নেয়ার নজির চোখে পড়ে নাই। এ সুযোগ নিয়ে এক শ্রেণীর বীমা নিবার্হী বীমা পলিসির টাকা বেতন ভাতা হিসাবে নিজেরা নিলেও বেচারা বীমা গ্রাহক মেয়াদ শেষে তার বীমাদাবীর টাকা ফেরৎ পা”্ছনে না। বীমা গ্রাহকের টাকায় কোম্পানির এমডি থেকে শুরু করে সকল পর্যায়ের কর্মকর্তাদের বেতন ভাতা নিয়মিত চলছে। এমনকি কোম্পানির বোড মিটিং ও বিভিন্ন কমিটির সভায় যোগদানকারি পরিচালকদের সম্মানি ভাতা ও রাজসিক খানা পিনার আয়োজনও করা হচ্ছে। কোন কোন দুর্বল কোম্পানিকে ঘটা করে কেক কেটে ইংরেজি নববর্ষ পালন করতে দেখা গেছে। এ ভাবে অপ্রয়োজনে গ্রাহকের টাকা খরচ করা হলেও বেল্লালের মতো একজন অসহায় বীমা গ্রাহকের ২৫ হাজার টাকার একটি বীমা দাবী পরিশোধে নানা টালবাহানা করা হচ্ছে।

 

Facebook Comments Box
advertisement

Posted ১:০৩ অপরাহ্ণ | রবিবার, ১৯ জানুয়ারি ২০২৫

Arthobiz |

এ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

advertisement
advertisement
advertisement

এ বিভাগের আরও খবর

সম্পাদক : অহিদুজ্জামান মিঞা
সম্পাদকীয় ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: খান ম্যানশন, ৮-ই, ২৮/এ-৫, টয়েনবি সার্কুলার রোড, মতিঝিল বাণিজ্যিক এলাকা, ঢাকা-১০০০।
ইমেইল: arthobiz61@gmail.com
যোগাযোগ: 01670045191